মানুষটি ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম প্রধান রসদদার। সেই হিসাবে সেজবাবু মথুরানাথ বিশ্বাস এবং ধনবান মুতসুদ্দি শম্ভুচরণ মল্লিকের পরেই তাঁর স্থান। রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের ইতিহাসে দানশীল এই মানুষটির প্রধান পরিচিতি ও খ্যাতি যেন সেটাই। আনুমানিক ১৮৮০ সালে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় তাঁর বয়স ছিল ত্রিশ বছর। তার কিছুদিন পর থেকেই তিনি ঠাকুরের সেবার জন্য এই রসদ যোগানোর কাজে নেমে পড়েন। ঠাকুরের কাছে এসে যাঁরা রাত্রিবাস করতেন, সেইসব ভক্তের জন্যও ডাল-রুটি, এমনকি লেপ, বালিশের ব্যবস্থা ক’রে দেন তিনি। ঠাকুরের অন্ত্যলীলাক্ষেত্র কাশীপুর উদ্যানবাটির মাসিক ৮০ টাকা ভাড়ার সবটা একাই দিতে আরম্ভ করেন ডস্ট কোম্পানির মুতসুদ্দি এই পরমভক্ত। শুধু তাই নয়, গরমে খসখসের পর্দা, আহারের জন্য ফল, সাজানোর জন্য ফুলের মালা—ঠাকুরের এমন যে কোনও ছোটখাটো সুবিধা-স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়েও তিনি সর্বদা মুক্তহস্ত ছিলেন।
এমনকি ঠাকুরের লীলাবসানের পর কাশীপুর উদ্যানবাটি যখন বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিতে হয়, তখন তারকনাথ, রাখ্তু-রাম (লাটু), গোপালচন্দ্র (বুড়ো গোপাল), কালীপ্রসাদের মতো ঠাকুরের তরুণ সেবকেরা নিরুপায় হয়ে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এমন সময় একদিন মানুষটি সান্ধ্য পূজার সময় ঠাকুরের দিব্য দর্শন লাভ করলেন। দেখলেন, প্রভু যেন বলছেন, “তুই করছিস কী? আমার ছেলেরা সব পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে—তার আগে একটা ব্যবস্থা কর।” টনক নড়ল তাঁর। পাগলের মতো দৌড়ে গেলেন নরেন্দ্রনাথের বাড়িতে। সমস্ত বৃত্তান্ত তাঁকে ব’লে সকাতর অনুরোধ করলেন, “ভাই, একটা আস্তানা ঠিক কর, যেখানে ঠাকুরের ছবি, ভস্মাদি আর তাঁর ব্যবহৃত জিনিসগুলি রেখে রীতিমতো পূজার্চনা চলতে পারে, যেখানে তোমরা কামকাঞ্চনত্যাগী ভক্তেরা এক জায়গায় থাকতে পার। মাঝে মাঝে আমরা গিয়ে সেখানে জুড়ুতে পারব। আমি কাশীপুরে যে টাকা দিতাম, এখনও তাই দেব।”
অনেক অনুসন্ধান আর কাঠখড় পোড়ানোর পর ১৮৮৬-র অক্টোবরের শেষদিকে এই আবেদনেরই ফলশ্রুতিতে বরাহনগরের গঙ্গাতীরে আদি রামকৃষ্ণ মঠের শুভ সূচনা হলো। মানুষটির মাসিক দানের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াল তখন ১০০ টাকায়! তাঁর এই বদান্যতা দেখে কথামৃতকার শ্রীম তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে লিখলেন, “…এই প্রথম মঠ তোমারই হাতে গড়া! তোমার সাধু ইচ্ছায় এই আশ্রম হইল।…ভাই, তোমার ঋণ কে ভুলিবে?”
দানবীর মানুষটির পোশাকি নাম শ্রী সুরেন্দ্রনাথ মিত্র। ঠাকুর কখনও তাঁকে ‘সুরেন্দ্রর’ বা কখনও আদর ক’রে ‘সুরেশ’ ব’লে ডাকতেন। কিন্তু আগাগোড়া তাঁর চরিত্রে কিন্তু এই দানশীলতার গুণবত্তা ছিল না। বৃন্দাবনে পাণ্ডাদের পাওনাগণ্ডা কিছু না দিয়ে বা সেখানকার নির্জন সাধনায় রত সাধু-বাবাজিদের কোনও প্রণামী না দিয়েই সুরেন্দ্র’র কলকাতায় পালিয়ে-আসার ঘটনা তাঁর মুখ থেকে শুনে ঠাকুর তাঁকে ভর্ৎসনা ক’রে বলেন, “ও ভালো কর নাই—সাধু-ভক্তদের কিছু দিতে হয়। যাদের টাকা আছে, তাদের ওরূপ লোক সামনে পড়লে কিছু দিতে হয়।”
সুরেন্দ্রনাথের ছিল গৌরবর্ণ, সুগঠিত ও বলশালী শরীর। অফিসের কাজে মাসিক তিন-চারশো টাকাও উপার্জন করতেন। বাইরে পাশ্চাত্যভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটালেও মনে কিন্তু শান্তি ছিল না তাঁর। মর্মান্তিক মানসিক যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে আত্মহননের কথাও জাগছিল মনে! এমন সময় একদিন বন্ধু রামচন্দ্র আর মনোমোহনের হাত ধরে পৌঁছলেন দক্ষিণশ্বরে, ঠাকুরের কাছে। স্বভাবে বোহেমিয়ান সুরেন্দ্রনাথ প্রথম দর্শনে ঠাকুরকে প্রণাম পর্যন্ত করেননি। কিন্তু সেদিনই তাঁর মুখের অমিয়বাণী শুনে মন টলে গেল পুরুষকারে বিশ্বাসী, তেজস্বী সুরেন্দ্র’র। ফেরার সময় যুগাবতারের পদধূলি গ্রহণ করতে আর ভুল হলো না তাঁর! অকূলে কূল পেয়ে প্রতি রবিবার কী এক অমোঘ আকর্ষণে যেতে লাগলেন দক্ষিণেশ্বরে, ইষ্টের পদপ্রান্তে।
এই ভক্ত সুরেন্দ্রনাথের বসতবাড়িতেই শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর শ্রেষ্ঠতম শিষ্য নরেন্দ্রনাথের প্রথম পার্থিব সাক্ষাৎ হয়। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ’ গ্রন্থে গ্রন্থকার স্বামী সারদানন্দজি সেদিনের ভারি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন (৫ম খণ্ড, ৩য় অধ্যায়)। তাঁর মতে সেই ঐতিহাসিক মিলনলগ্নটি ছিল ১৮৮১-র নভেম্বরের কোনও একটি দিন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ.এ. পরীক্ষার্থী নরেন্দ্রনাথ তখন ১৮ বছরের তরতাজা যুবক। ঠাকুরের বয়ঃক্রম ৪৬ পূর্ণ করতে আরও মাস তিনেক বাকি।
১৮৮৫ সালে, সুরেন্দ্রনাথের এই বাড়িরই দুর্গোৎসবে ঠাকুর অসুস্থতার কারণে যেতে পারেননি। গলরোগের চিকিৎসার জন্য তখন তিনি শ্যামপুকুর বাটিতে অবস্থান করছেন। বিজয়ার দিন শোকার্ত সুরেন্দ্র মাতৃবিরহকাতর অবস্থায় প্রভুর পদপ্রান্তে উপনীত হলে তাঁকে দেখে ঠাকুর শ্রীমকে বলেন, “কী ভক্তি! আহা, এর যা ভক্তি আছে!” তারপর ঠাকুর সুরেন্দ্রকে জানান, তাঁদের বাড়ির দুর্গাদালানে ঠাকুরের দিব্যভাবে প্রতিমাদর্শনের কথা!
ভক্তভৈরব নট ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের মতো সুরেন্দ্রনাথেরও সুরাপানে বড়ই আসক্তি ছিল। একদিন বকুলতলায় ব’সে ভাবস্থ ঠাকুর অকস্মাৎ তাঁকে মদ্যপানের অভ্যাস ত্যাগের আদেশ না দিয়ে কেবল বলেন, “দেখ, যা খাবে, ঠাকুরকে নিবেদন ক’রে খাবে; আর যেন মাথা না টলে, পা না টলে। তাঁকে চিন্তা করতে করতে তোমার পান করতে আর ভালো লাগবে না—তিনি কারণানন্দদায়িনী। তাঁকে লাভ করলে সহজানন্দ হয়।” ক্রমে আরও কয়েকটি ঘটনা পরম্পরায় সুরেন্দ্রনাথ “রোগমুক্ত হইবার উত্তম পথ পাইলেন।” শুধু তাই নয়, একদিন শুভমুহূর্তে তিনি পরমপুরুষের আশীর্বাদও লাভ করলেন, “আনন্দময়ী করুন, তোমরা সকলে আনন্দে থাক।”
সুরেন্দ্রনাথের ইচ্ছা ছিল গঙ্গাতীরে একটি ভূখণ্ড কিনে সেখানে পরমপ্রভুর পুণ্যাস্থি সমাহিত করা। সেজন্য তিনি সেই যুগে এক হাজার টাকা দান করার পরও, প্রয়োজনে আরও অর্থদানের অঙ্গীকার করেন। যাঁদের মাধ্যমে তাঁর গুরুসান্নিধ্যে আসা, সেই রামচন্দ্র ও মনোমোহনের পরামর্শে সুরেন্দ্রনাথ সর্বধর্মসমন্বয়ের বার্তা দিতে একটি সুন্দর প্রতীক নির্মাণ করান, যাতে বৈষ্ণবদের খুন্তি, খ্রিস্টানদের ক্রশ আর ইসলামের পাঞ্জা মিলিত হয়েছে। এছাড়াও নিজ ব্যয়ে সর্বধর্মসমন্বয়ের একটি চিত্র অঙ্কন করিয়েছিলেন তিনি। যেখানে দেখা যাচ্ছে শিবদেউল, মসজিদ ও গির্জার সামনে বিভিন্ন ধর্মের অবতারপুরুষরা দাঁড়িয়ে আছেন; ভগবদ্ভাবে নৃত্যগীতও চলছে। অন্যদিকে পরমহংসদেব কেশবচন্দ্রকে মহামিলনের এই মনোহর দৃশ্য দেখাচ্ছেন। সুরেনের যত্ন ও ব্যয়ে দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটীতে ঠাকুরের প্রথম জন্মতিথি উৎসবও উদ্ যাপিত হয় ১৮৮১ সালে। প্রথম দু’বছরের জন্মোৎসবের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার একার কাঁধে তুলে নেন সুরেন্দ্রনাথ। তৃতীয় বছর থেকে অন্যান্য ভক্তরা তাঁর এমন মহতী উদ্যোগের অংশীদার হন।
গুরুসেবায় নিবেদিত এমন মহাপ্রাণ স্বল্পায়ু ছিলেন। এই বিশাল কর্মকাণ্ড করার জন্য তিনি সময় পেয়েছিলেন মাত্র দশ বছরেরও কম সময়—১৮৮১ থেকে ১৮৯০!
তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ-পাদপদ্মে মিলিত হন ৪০ বছর বয়সে।