শ্রীরামকৃষ্ণদেব
পানিহাটির ‘রামচাকি’: শ্রীরামকৃষ্ণদেবেরও অত্যন্ত প্রিয় ছিল এই সন্দেশ

কলকাতা: ‘রামচাকি’। এই মিষ্টির সঙ্গে অবশ্য রাজা-জমিদার, সাহেবসুবোর কোনও সম্পর্ক নেই। রামচাকি-কে অমরত্ব দিয়েছেন স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। অবশ্য ঠাকুরের কথায় আসার আগে আমাদের ফিরে যেতে হবে তারও আগের ইতিহাসে।

গৌর-নিতাইয়ের স্মৃতিধন্য পানিহাটি

পানিহাটি (Panihati)। অতীতের ‘পণ্যহট্ট’। ইতিহাসমতে, পূর্ববঙ্গে যশোরের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগের অন্যতম কেন্দ্র। সবই নদীপথে। তারপর স্বাধীনতা, দেশভাগ। একদা বঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ ‘বাণিজ্যতট’ কালের নিয়মে ‘পৌরসভা’য় এসে ঠেকেছে। তবু এর শরীর থেকে মুছে যায়নি ইতিহাসের ধুলো।

পানিহাটির সঙ্গে বাঙালির নাড়ির বাঁধনটি বেঁধে দিয়েছিলেন যিনি, তিনি শ্রীচৈতন্যদেব। জনশ্রুতিমতে, মহাপ্রভু দু’বার পানিহাটি ভ্রমণ করেন। নৌকাপথে নেমেছিলেন মহোৎসবতলা ঘাটে। একবার নবদ্বীপ থেকে পুরী যাওয়ার পথে (১৫১৫ খ্রিস্টাব্দ)। আরও একবার গৌড় হয়ে পুরী থেকে বৃন্দাবন যাওয়ার সময়৷ পানিহাটিতেই ছিল শিষ্য রাঘব পণ্ডিতের নিবাস। সেখানেই বার দুই এসেছিলেন চৈতন্যদেব। পাশাপাশি এই অঞ্চলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রভু নিত্যানন্দের স্মৃতিও। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন নিত্যানন্দ। পথে পানিহাটিতে বিশ্রাম করেন। নিতাইকে চোখের দেখা দেখতে সেখানে অগণিত তীর্থযাত্রীদের আগমন হয়। এই উন্মাদনা দেখে নিত্যানন্দ ফিরে যাওয়ার আগে নির্দেশ দেন, ভক্তদের মধ্যে দই-চিড়া বিতরণ করতে ৷ সেই থেকে পানিহাটিতে বিখ্যাত বৈষ্ণব-সমাবেশের সূচনা।

পানিহাটি, রামচাকি ও শ্রীরামকৃষ্ণদেব

উনিশ শতকে বাংলায় ভক্তি আন্দলন যখন বিভিন্ন দিকে ধাবিত হচ্ছে, তখন সর্বধর্মসমন্বয়ের মূর্ত প্রতীক শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব (Shri Ramakrishna Dev) দু’বার পানিহাটি আসেন। প্রথমবার ১৮৮৩-তে। তারপর ১৮৮৫ সালে। দণ্ড-মহোৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন। কিন্তু রসনাপ্রিয় বাঙালি এই ঘটনাকে স্মরণে রেখেছে মিষ্টান্নের সূত্রে। নাম ‘রামচাকি’ (Ramchaki)। কথিত আছে, বিশেষ কায়দায় প্রস্তুত গোলাকার ছানার মণ্ডটি রামকৃষ্ণের মন জয় করেছিল। সপার্ষদ পানিহাটি এসেছিলেন তিনি। স্থানীয় ভক্তবৃন্দ তাঁকে ঘোড়ার গাড়ি করে শম্ভুচরণ পালের দোকানে নিয়ে যান। তখন শম্ভুবাবুর দোকান ছিল গঙ্গাতীরে, বাজারঘাটের কাছে।

অন্য একটি মতে, শম্ভুচরণ নয়, রামকৃষ্ণ রামচাকির স্বাদ নিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ মোদকের দোকানে। কিন্তু তাঁকে ঘোড়ার গাড়ি করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি যদি ঐতিহাসিকভাবে সত্যি হয়, তাহলে প্রথম অনুমানই গ্রহণযোগ্য। কারণ, শ্রীকৃষ্ণ মোদকের দোকান দণ্ড-মহোৎসবের উৎসবস্থলের কাছে। তুলনায় শম্ভুচরণের দোকান বেশ কিছুটা দূরে।

যাই হোক, শম্ভুচরণ পালই যে রামচাকির উদ্ভাবক এই বিষয়ে ঐতিহাসিকেরা একমত। শম্ভুচরণ প্রথমে দোকানে খোলেন পানিহাটি বাজারে, রাধাগোবিন্দ জীউর মন্দিরের কাছে। তাঁর মৃত্যুর পর দায়িত্ব তুলে নেন পুত্র পশুপতিনাথ পাল। তারপর শরিকি বিবাদ। দোকান ভাগ। অনেক টালবাহানার পর পশুপতিবাবুর ছেলে প্রশান্ত পাল নতুন করে সাজিয়ে তোলেন ‘পাল সুইটস’। পানিহাটির আরেক প্রসিদ্ধ মিষ্টি গুপো সন্দেশের পাশপাশি রমরমিয়ে আজও বিকোচ্ছে রামচাকি। দোকান নিতান্তই ছাপোষা। দেয়ালে ইতিহাসের গরিমা-দর্শানো কোনও ব্যানার বা পোস্টার লাগানো নেই। তবু এলাকার মানুষ একডাকে রামচাকি সন্দেশের ‘বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান’ বলতে পাল সুইটসকেই চেনেন।

ছানা কড়াইয়ে বসিয়ে শুরু হয় পাক দেওয়া। অল্প অল্প করে চিনি ঢেলে তা পাকানো হয়। তার কিছুক্ষণ বাদে কারিগরেরা ছোট এলাচের গুঁড়ো মিশিয়ে দেন। কড়াই থেকে নামানোর পর খানিক অপেক্ষা। পরের ধাপ: ছানার মিশ্রণ ঠান্ডা হলে ছোটবড় মণ্ড কাঠের ছাঁচে ফেলা। তারপর হাল্কা হাতের চাপ। ব্যাস! তৈরি হয় রামচাকি সন্দেশ।