হায়দরাবাদ: গৌতম বুদ্ধের ধর্মের সূচনা ছিল এক বিপ্লবী নির্জনতা দিয়ে। তিনি বলেছিলেন—কোনও ঈশ্বর নেই, আত্মাও নেই, যজ্ঞে মুক্তি মেলে না, বর্ণাশ্রমধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব কল্পনামাত্র। তাঁর চারটি আর্যসত্য এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গ ছিল এক আত্মশুদ্ধির নীরব ভাষ্য, যেখানে শব্দ ছিল পরিমিত, অলৌকিকতা নিষিদ্ধ, এবং প্রজ্ঞা ছিল মুক্তির একমাত্র উপায়। তবু কালের প্রবাহে, সেই ধর্মেই প্রবেশ করল মন্ত্র, মুদ্রা, যন্ত্র, অলৌকিক শক্তি, দিক্পাল, যোগিনী, এবং রক্তপাত্রভরা তান্ত্রিক সাধনার বিস্তার।
এই রূপান্তর ছিল কি বিচ্যুতি? না কি ইতিহাসের বাস্তবতা?
এই প্রবন্ধ সেই যাত্রার রূপরেখা—যেখানে বুদ্ধের মৌন বোধ একদিন হয়ে উঠল বজ্রসত্ত্বর ধ্বনি।
বুদ্ধের ধর্ম: একটি বৌদ্ধিক প্রতিপক্ষতা
প্রথমেই মনে রাখা দরকার, গৌতম বুদ্ধ ছিলেন সেই যুগের প্রতিনিধি, যখন সমাজে বেদপ্রণীত ব্রাহ্মণ্য পরম্পরা অপরিহার্য বলে বিবেচিত হত। উপনয়ন, যজ্ঞ, পুরোহিততন্ত্র, এবং বর্ণাশ্রমধর্ম তখনকার সমাজের মূল সুর।
বুদ্ধ তা সবকিছুই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন—
• তিনি বলেন, বেদ প্রমাণ নয়
• ঈশ্বর বলে কিছু নেই, সমস্ত বস্তু অনিত্য
• আত্মা এক বিভ্রম, দুঃখ জন্মায় আসক্তি থেকে
• এবং মুক্তি আসে নিজচেতনা নির্মাণে, কোনও বাহ্য আচারে নয়
তাঁর ধর্মের ভিত্তি ছিল—
• চারটি আর্যসত্য
• অষ্টাঙ্গিক পথ
• অনাত্মা ও অনিত্যতার দার্শনিক স্বীকৃতি
• সংযম, করুণা ও প্রজ্ঞা
এইভাবেই তিনি নির্মাণ করলেন এক যুক্তিনির্ভর, অভিজ্ঞতালব্ধ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক মুক্তিপথ—যেখানে কোনও দেবতা নেই, নেই স্বর্গ-নরকের ভয়, নেই দোষী ঠাকুর ও দণ্ডদাতা ঈশ্বর।
❖ অলৌকিকতা নিষিদ্ধ, সংযমই সাধনা
বুদ্ধ সরাসরি নিষিদ্ধ করেছিলেন যেকোনও রকম অলৌকিকতা।
তিনি বলেন—
“যে ভিক্ষু অলৌকিক শক্তি প্রদর্শন করে, সে দুষ্টকর্মী।”
“ধর্ম প্রচারের জন্য চমক নয়, সংযমই যথেষ্ট।”
“ইন্দ্রজাল, ভবিষ্যদ্বাণী, বা মন্ত্র দ্বারা অন্যকে প্রভাবিত করা অপরাধ।”
তাঁর ধর্ম ছিল এক মৌন প্রতিজ্ঞা—নিজেকে জানো, দুঃখকে চিনো, মায়া ভেঙে যাও।
তাহলে কেন এলো মন্ত্র, তন্ত্র, দেবতা, অলৌকিক শক্তি?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাদের দেখতে হবে—ধর্ম কেবল দার্শনিক কাঠামো নয়, সেটি এক সামাজিক প্রতিক্রিয়া। বুদ্ধ যা বলেছিলেন, তা জ্ঞানের কথা। মানুষ যা খুঁজছিল, তা আশ্রয়ের কথা।
১. দর্শন ও সাধারণ মানুষের দূরত্ব
“অনিত্য”, “অনাত্মা”, “শূন্যতা”—এই তত্ত্বসমূহ একটি জটিল অভিজ্ঞতা, যা সকলের পক্ষে অনুধাবনযোগ্য নয়।
জনগণ বরং চায়—
• কানে শোনা মন্ত্র
• চোখে দেখা দেবতা
• হাতে ধরা রক্ষাকারী চিহ্ন
এই চাহিদার জায়গা থেকেই ধর্মের ভাষা বদলাতে থাকে—তাত্ত্বিক ভাষ্য থেকে অভিসন্ধির অভিজ্ঞান।
সেই অভিজ্ঞান হল—
• মন্ত্র (ধ্বনির শক্তি)
• তন্ত্র (রীতির রহস্য)
• যন্ত্র (দৃষ্টিযোগ্য প্রতীক)
• অলৌকিক অভিজ্ঞতা (রক্ষা ও প্রভাব)
২. লোকধর্মের চাপ
ভারতীয় সমাজ বরাবরই ছিল আচারকেন্দ্রিক।
লোকমানসে ধর্ম মানে ছিল—
• রোগ সারানোর উপায়
• সন্তানের জন্য সংকল্প
• শত্রু দমন ও মঙ্গল কামনা
• গৃহের রক্ষা ও পূর্বপুরুষের তুষ্টি
এইসব চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধের দর্শন খুব শীঘ্রই পূজার অলংকারে ঢেকে যায়।
লোকমানস বুদ্ধকে পরিণত করে—
• বোধিসত্ত্বে, যিনি চেতনায় অধিষ্ঠান দেন
• ধারণীকর্তায়, যাঁর নামের মন্ত্র দুঃখ নাশ করে
• তান্ত্রিক কেন্দ্রে, যিনি চক্রে বসে যোগিনীদের অধীশ্বর
৩. উপায়কৌশলের বিস্তার
বুদ্ধ নিজে যদিও নিষিদ্ধ করেছিলেন অলৌকিকতা, তবু তিনি বলেছিলেন— “উপায় কৌশলে ধর্ম প্রচার করো।”
এই “উপায়” হয়ে দাঁড়ায়—
• দর্শনের রূপকে মন্ত্রের ধ্বনি
• সংযমের ভাষায় যন্ত্রের রেখা
• প্রজ্ঞার সহচরী হিসেবে যোগিনী