tantra in buddhism
ঐতিহাসিক প্রবাহে তন্ত্রের আত্মপ্রকাশ হল কীভাবে ?

হায়দরাবাদ: গুপ্তযুগে মহাযান, বজ্রযান ও তান্ত্রিক শাখার বিস্তার ৷ খ্রিস্টীয় তৃতীয় থেকে অষ্টম শতক অবধি বৌদ্ধধর্মে দেখা যায় এক নবতান্ত্রিক উত্থান—যেখানে জন্ম নেয়:

• গুহ্যসমাজতন্ত্র

• বজ্রধানীতন্ত্র

• সাধনমালা

• চক্রসম্বরতন্ত্র

• বজ্রচর্চিকা ও বজ্রবারাহী সাধনা

এগুলোতে রয়েছে—

• যোগমুদ্রা

• মন্ত্রমালা

• দিক্‌পালের স্থাপন

• চক্র, পদ্ম, কর্পূর-রক্ত-পাত্র

এইসব রচনায় বুদ্ধ আর কেবল একজন শিক্ষক নন—তিনি হলেন ত্রিকালজ্ঞ, অলৌকিক অধিষ্ঠাতা, সিদ্ধিপ্রদাতা বজ্রসত্ত্ব।

দেবীমণ্ডল ও যোগিনী সাধনা

বজ্রযানে বুদ্ধের পাশে বসানো হয়—

• বজ্রযোগিনী

• চক্রসম্বর

• তারা, বজ্রবারাহী, মারিচী, নিলা সরস্বতী

তারা শুধুমাত্র রূপ নয়, তারা ছিল—

• চেতনার বিশেষ স্তরের প্রতীক

• অভিসন্ধির বহিঃপ্রকাশ

• মন্ত্র ও মুদ্রার বাস্তব প্রতিফলন

প্রতিটি দেবতা ছিল— “চেতনার এক এক প্রতিফলন, যাঁরা সাধকের মধ্যে নিজ নিজ শক্তি জাগিয়ে তোলেন।”

❖ অলৌকিকতা ও অভিসন্ধি: বুদ্ধের মানদণ্ড

এক বিখ্যাত ঘটনা—ভিক্ষু ভরদ্বাজ মন্ত্রবলে আকাশে ঝুলন্ত বাটি নামিয়ে আনেন।

জনতা অভিভূত, কিন্তু বুদ্ধ বললেন— “এই কর্ম দুঃকট, কারণ এটা অহংকার-প্রদর্শন।”

অন্যদিকে মেণ্ডক নামক এক গৃহস্থ, যিনি প্রার্থনায় বৃষ্টি ও অন্ন উৎপন্ন করতেন—তাঁর কৃত্যকে বুদ্ধ অনুমোদন করেন। কেন?
কারণ—

• ভরদ্বাজের উদ্দেশ্য ছিল “চমক”

• মেণ্ডকের উদ্দেশ্য ছিল “সেবা”

সুতরাং বুদ্ধের চোখে অভিসন্ধি—অর্থাৎ “উদ্দেশ্য”—হল ধর্মের বিচারক।

❖ তন্ত্র: বিচ্যুতি নয়, এক প্রবাহিত ব্যাখ্যা

তন্ত্রের প্রবেশকে অনেকেই বলেন “বিচ্যুতি”।

কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল—

• এক সাংস্কৃতিক প্রয়োজন

• এক আভিজাত্যহীন সমাজে বোধগম্য ধর্মের অনুবাদ

• এক দর্শনের বাহির-প্রয়োগের ভাষ্য

বুদ্ধ নিজে তন্ত্রদাতা ছিলেন না, কিন্তু তন্ত্রের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাকে জনমুখী, অভিজ্ঞানময় ও প্রাসঙ্গিক করে তোলা সম্ভব হয়েছিল।

❖ আধুনিক ধ্বনি: বৌদ্ধ মন্ত্রের সমকালীন রূপ

আজও শুনি—

• ওঁ মণি পদ্মে হুঁম (অভয়দান)

• ওঁ বজ্রসত্ত্ব হুঁম (পাপনাশ)

• ওঁ তারে তুতারে ture সোহা (রক্ষা)

 

এইসব ধ্বনি অলৌকিক নয়—এগুলি মননকে ধ্বনিতে রূপান্তরের প্রয়াস।

তাই আজকের বৌদ্ধধর্মে—

• মন্ত্র আছে, কারণ মন আছে

• তন্ত্র আছে, কারণ রীতি চাই

• অলৌকিকতা আছে, কারণ আশ্রয় চিরকালীন

উপসংহার: সংযম ও অলৌকিকতার এক অন্তর্লীন সেতু

বুদ্ধ যা শুরু করেছিলেন, তা ছিল চুপচাপ, একক, ধ্যানসন্ধানী আত্মগমনের পথ।

লোকজ চেতনা তা বদলে বানিয়েছে—

• মন্ত্রভিত্তিক আচার

• অলৌকিক প্রতিশ্রুতির ধর্ম

• দিক্‌পাল ও যোগিনীসঞ্চালিত মণ্ডল

তবু কোথাও যেন, এই দুইয়ের মাঝখানে, বুদ্ধের মৌনতা রয়ে গেছে।

একজন আধুনিক বৌদ্ধ যখন মন্ত্র জপ করেন, বা যন্ত্র স্থাপন করেন—তিনি কেবল আশ্রয় খোঁজেন না; তিনি নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে শিখেন।

এই শিক্ষাই বুদ্ধের—“আত্মদীপো ভব”—নিজেই নিজের আলো হও। মন্ত্র শুধু ধ্বনি নয়, তা আত্মার প্রতিধ্বনি। তন্ত্র শুধু রীতি নয়, তা চেতনার শৃঙ্খলা। আর অলৌকিকতা শুধু বিশ্বাস নয়, তা এক বাস্তব আশ্রয়ের রূপান্তর।